খাদ্যে ভেজাল এমন একটি আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফরমালিন, কার্বাইড মেশানো বিষাক্ত ফল খাওয়া আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আইন থাকলেও কাগুজে-কলমে, বাস্তবায়ন হয় না। চিকিৎসকরা বলছেন, এসব বিষাক্ত খাবার খেয়ে ক্যান্সারের মতো ঘাতক ব্যাধি তৈরী হচ্ছে। পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছেন, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব প্রতিরোধে মহামান্য হাইকোর্টেরও নির্দেশনা রয়েছে; কিন্তু সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল মেশালে বা ভেজাল খাদ্য ও ওষুধ বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করার অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ কারাদন্ডের বিধান আছে। কিন্তু মামলা ও শাস্তির সংখ্যা নিতান্তই কম। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর দায়ে মৃত্যুদন্ড হয়েছে-এমন নজির নেই বললেই চলে।
পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করেছিলেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যের মান বজায় রাখাসহ নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালের ২০ জুন রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই রায়ে প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত গঠন এবং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে খাদ্যের মান ও রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য খাদ্য পরীক্ষক নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সে রায় আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
আমাদের আলোচিত-সমালোচিত ভ্রাম্যমাণ আদালত রয়েছে। এ আদালত (বিএসটিআই) অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকে। এতে শাস্তির মেয়াদ কম। জরিমানারও বিধান রয়েছে। এ কারণে ভেজাল মিশিয়ে গুরুতর অপরাধ করলেও অপরাধীরা কম সাজায় পার পেয়ে যায়। যেহেতু অল্প সাজায় মাফ পেয়ে যায়, তাই এ ধরনের ঝুঁকি তারা নিতে অভ্যস্তও বটে। এমনও দেখা যাচ্ছে, একই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা পেয়েছে।
ওষুধ প্রাণিদেহের রোগ প্রতিকার করে। কিন্তু সেই ওষুধ যখন প্রাণীদেহে ক্যান্সারের মতো মরণ ব্যাধি সৃষ্টি করে, তখন নিরাপত্তা কোথায়? সম্প্রতি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ টাপেন্টাডলকে মাদকদ্রব্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এই ওষুধকে মাদকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করায় একে ‘খ’ শ্রেণির মাদক হিসেবে তফসিলভুক্ত হয়েছে।
আমাদের দ-বিধির ২৭২ ও ২৭৩ ধারায় খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তির বিধান রয়েছে। ২৭২ ধারায় বিক্রির জন্য খাদ্য বা পানীয়তে ভেজাল মেশানোর দায়ে কোনো ব্যক্তিকে অনধিক ছয় মাস পর্যন্ত শাস্তির বিধান রয়েছে। ২৭৩ ধারায় ক্ষতিকর খাদ্য ও পানীয় বিক্রির অপরাধেও ছয় মাসের শাস্তির বিধান রয়েছে। ওষুধে ভেজাল মেশানো বা ভেজালমিশ্রিত ওষুধ বিক্রির জন্য দন্ডবিধির ২৭৪ ও ২৭৫ ধারায়ও সর্বোচ্চ ছয় মাসের শাস্তির বিধান রয়েছে।
১৯৫৯ সালে মানুষের ভোগের জন্য খাদ্য প্রস্তুত, বিক্রি অধিকতর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশের ৬ ধারা থেকে ৩৭ ধারা পর্যন্ত খাদ্যে ভেজাল মেশানো, ভেজাল খাদ্য বিক্রি, ভেজাল খাদ্যবিরোধী অভিযানে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বাঁধা দেওয়ার জন্য শাস্তির বিধান করা হয়। দ-বিধির তুলনায় সাজার মেয়াদ বাড়ানো হয়। বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশের এসব ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর আর সর্বনিম্ন ছয় মাস কারাদ- দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পাঁচ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়।
এরপর রয়েছে একজন ভোক্তার নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার। পণ্য সম্পর্কে জানার ও পছন্দের অধিকার। অভিযোগ দায়ের ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার। ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার। এ আইনটিও কাগুজে কলমে সীমাবদ্ধ।
আসুন আমরা আইনগুলোর একটা সমন্বয়ও করি। নয়তো একই অপরাধে শাস্তির মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হচ্ছে। অপরাধীরা নির্ভয়ে কাজ করে চলছে। আমরা ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮